সংসারের মায়া

  Generate Earning Link

আজ আমি চার  বছরের সংসারের শেষ দিনটি পার করছি। 

 

ঠিক এই দিনে বৌ হয়ে এসেছিলাম বাসেতের জীবনে। 

 

এক বুক ভালবাসা নিঃস্বার্থ সময় ব্যায় করেছি ভুলের সংসারে।

 

এই সংসার ছেড়ে আমাকে কোনদিন ও চলে যেতে হব!! স্বপ্নেও ভাবিনি।

 

মানুষ ছাড়া ও যে বস্তুর টান এত গভীর হয় তা যাবার সময় ঝুলাম।

 

আমরা ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের আগে আরো তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করেছি। 

 

তখন বয়স বেশি ছিলো না। সবে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। মাস্টার্স  শেষ করে আর অপেক্ষা করিনি। 

 

বাসা থেকে অবশ্যই পাত্র দেখা শুরু করেছিল। আমি আমার একমাত্র বন্ধু ছোট খালা মিঠুকে বাসেতের কথা বলে রেখেছিলাম। এবং এও বলেছিলাম আমার বিয়ে অন্যত্র ঠিক করলে বাসা থেকে পালিয়ে যাবো।

 

তাই আর কেউ এ ব্যাপারটা ঘাটায় নি। বাসেত সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছেন।

 

আব্বা নিজেই সরাসরি বাসেতের অফিসে গেছেন। ও তখন চেয়ারে ছিলো না। 

 

এই সুযোগে অন্যদের কাছ থেকে রিপোর্ট নিয়েছেন। তারপরেও অপেক্ষা করেছেন।

 

চলে আসার সময় কেউ একজন বললো, ওই তো বাসেত সাহেব এসে গেছেন।

 

এক নজরে ভালো লেগে গেলো বাসেতকে। মহা ধুমধামে বিয়ে দিলেন।

 

আমি চলে এলাম যাত্রাবাড়িতে। ফ্ল্যাটটি সত্যি সুন্দর।  বেশ বড়সড়। তিনখানা থাকবার ঘর। ডাইনিং কিচেন স্টোর বাথরুম মিলে বেশ বড়। 

 

আমরা এত বড় ফ্ল্যাটে থাকিনি।মোটামুটি আমাদের চলে যায়। আব্বা তথ্য মন্ত্রণালয়ে জুনিয়র অফিসার। প্রচন্ড সৎ মানুষ। বিয়েতে দাদির সীতাহারটা আমাকে দিলেন। 

 

মা ভেবেছিলেন ওটা একমাত্র ছেলের বৌ পাবে। আমি আব্বার চোখের মনি। 

 

বাসেত বায়িং হাউজে চাকরী করে। মোটা অংকের বেতন।ভাগ্য বলতে হবে। এত অল্প সময়েই এই উন্নতি! 

 

বেতন পেয়ে মা বাবাকে টাকা পাঠিয়ে দেয়, আমাকে হাত খরচ বাবদ দশ হাজার টাকা দেয়। মাসের বাজার বাসেত করে। টুকিটাকি প্রয়োজনে আমি খরচ করি। 

 

আমি ওই দশ হাজার টাকা থেকে কৃপণের মত খরচ করি। বাসেত হেঁসে  হেঁসে বলে মল্লিকা তুমিতো এত কিপ্টে ছিলে না!! 

 

এক বছরেই টুকটাক ফানির্চার কিনেছি। ঘর সাজানোর সামগ্রী কিনেছি। 

বিশেষ করে বসার ঘরটা। 

 

একদিন পাশের ফ্ল্যাটের মৌসুমিদি এসে চোখ কপালে তুলে বললেন - কই এদিকে এসো মল্লিকা। এ কী করেছো!! চোখ ফেরানো যাচ্ছে না।

 

ড্রয়িং রুমেই আমরা চা খেলাম।

 

বাসেতকে আমি যে ভাবে চেয়েছিলাম ওপর ওয়ালা তা দ্বিগুণ করে দিয়েছেন। 

 

ওর ভালবাসা ছিলো প্রতিটি মেয়ের চাওয়া। 

 

অফিস থেকে দশ বারো বার ফোন করবে। আমি একা থাকি। কোন বিপদ আপদ হলো কী না তার খোঁজ নেয়।

 

অফিসে দায়িত্ব বেড়েছে। মাঝে মাঝে সাভার যেতে হয়। দুতিনদিন ওখানে থাকতে হয়। 

 

শ্বশুর শাশুড়ীকে আনিয়ে নিয়েছি। শ্বশুর এক সময় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের চাকরি করতেন। ভালো রকম পেনশন পান। ছেলেও শখ করে বাবা মাকে টাকা পাঠায়।

 

শ্বশুর নিজের পছন্দ মত তাদের থাকার রুমটা সাজিয়ে নিয়েছেন।যদিও সব আমার পছন্দের জিনিসপত্র। 

 

শাশুড়িমা রান্নাঘরের দায়িত্ব নিয়েছেন। 

 

আমার কাজ হলো বাসেতের কাপড় জামা ঠিক রাখা, ফার্নিচার মোছা, বারান্দার ফুলগাছের যত্ন নেয়া।

 

অবসরে মুভি দেখা।

 

এমন হলো! আমার ঘর ছেড়ে একটা দিনও মা'র বাড়ি থাকতে পারিনা।

 

 বাসেতের চেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠলো  বাসেতের অফিস যাওয়া- ফিরে আসার ক্ষণটি। 

 

পরিপাটি করে রাখা সংসার ওকে টানে। 

 

মা বাবাও ওর   ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকেন। আমরা চারজন মিলে বিকেলের চা নাস্তা করি। 

 

শাশুড়িমা প্রতিদিন বিকালে মজার মজার নাস্তা তৈরি করেন।

 

শূণ্যতা শুধু একটা বাচ্চার। বাসেতকে বলি, ওর একটাই কথা এত তাড়াতাড়ি নয়। জীবনটা উপভোগ করতে দাও।

 

চলে গেলো আরো তিনটি বছর। বাসেতের দায়িত্ব বেড়েছে। দু-তিন দিন সাভারে থাকতে হয়।

 

ঘরটা আমার কাছে সন্তানের মত। আমি শুয়ে বসে থাকলেও ওদের কথা বুঝি।

এমন হলো!! মনে হচ্ছে সো- কেছটা আমার আদর নেবার জন্য উতলা হয়ে পড়েছে। পরিষ্কার একটা ন্যাপকিন দিয়ে বাচ্চাদের শরীরিরে লেগে থাকা ময়লা সরাচ্ছি।

 

সত্যি!  একটা বাচ্চার অভাব আমি মেনে নিতে পারছিনা। 

 

শাশুড়ি মা খুব আদর করেন। মজার খাবারের ভালোটুকু আমার পাতে আসে।

 

বিকালের নাস্তার নুন ঝাল মিষ্টি  আমাকে দেখতে হয়।একটু একটু করে নুন ঝাল দেখতে দেখতে অনেকটা খাওয়া হয়ে যায়। 

 

বাসেত প্রায়ই বলে- মা! তুমি কী আমার শাশুড়ি!!  আর মল্লিকা তোমার মেয়ে!

 

মা অভিমানি সুরে বলবেন- তোর গোবর ভরা মাথায় এগুলোই আসে!!

 

আমি এবার শক্ত করে ধরেছি।আর কত! চার বছর অনেক উপভোগ করেছি।বাচ্চা আমার চাই ই চাই। 

 

বাসেত একটু হেসে বললো- আর তর সইছে না!! বুঝবে মজা। এখন তো ঝাড়া হাত পা। বাচ্চা এলে তুমি ওর জন্য কতটা সময় দেবে মহারানী!  আমার আদরে ভাটা পড়বে। 

 

ওমা! সে কী কথা! ভাটা পড়বে কেন? তুমি অফিস থেকে ফিরে দেখবে দাদুর কোলে চড়ে গুল্টু বেলুন কিনতে গেছে।

 

কত জমিয়ে থাকা গল্প বলবে। 

 

আমায় কথা দিয়ে সাভার গেলো। তিনদিন থাকবে। 

 

আসার সময় হয়ে গেছে। বিকালে ফিরবে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেলো। বাসেত ফিরছে না।

 শ্বশুর অফিসে ফোন করেই যাচ্ছেন।  পাঁচ টায় ছুটি হয়ে গেছে।

 

- মা, তোমার কাছে ওর কোন বন্ধুর মোবাইল নম্বর আছে!

 

-- হ্যা,বাবা।  সিরাজ সাহেবেরটা আছে। 

 

- আমাকে দাও

হ্যালো হ্যালো সিরাজ বলছেন?

 

 --হ্যা, বলছি।

 

- আমি বাসেতের আব্বা। ওরাতো বিকালে ফেরার কথা। এখন রাত হয়ে গেলো!!

 

-- চাচা আপনি সাভার হসপিটালে চলে আসুন। 

 

-- কোন খারাপ সংবাদ? 

 

-- মনে, আপনি আসুন। খুব তাড়াতাড়ি আসুন।

 

- বাবা, কি কথা হলো! আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? 

 

-- মা, তৈরি হয়ে নাও। আমরা সাভার যাবো।

 

-- পলকে সব এলোমেলো হয়ে গেলো।বাবা শক্ত হতে বললেন। 

 

কী ভাবে আমি শক্ত হবো!! আমার সোনার সংসার। দয়াময় আমরাতো খুব সুখি ছিলাম। এত তাড়াতাড়ি তুমি কঠিন হয়েও না। 

 

হাসপাতালের কাছে আসতেই অজানা আশংকায় বুক কেঁপে উঠলো।

 

রিসিপশনের মেয়েগুলো ছুটে এসে আমার শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করলেন বাসেত সাহেব আপনার কে হন? 

 

- জ্বি, আমি ওর বাবা।

 

,- আপনি ভেঙে পড়বেনা। ওনার স্ত্রীর অবস্থা খুব খারাপ। ঠিকমত জ্ঞান ফিরছে না। ওদের বাচ্চাটা নানুর কাছে আছে।মারাত্মত এক্সিডেন্টে  বাসেত সাহেব স্পটে মারা জান। 

 

  আপনি একটু শান্তনা দিন। মিসেস বাসেত স্বামীর মৃত্যুটা মেনে নিতে পারেন নি। 

 

- আমার শ্বশুর ওয়েটিংরুমে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। 

 

আমি খুব স্বাভাবিক।  জীবন থেকে কে চলে গেছে মনে করতে পারছি না। 

 

ফ্যালফ্যাল করে চারিপাশ দেখছি।

 

কেমন নিস্তব্ধতা আমাকে ঘিরে রেখেছে।

একটা কথাই কানে ভাসছে -

 

-- ওনার স্ত্রীর অবস্থা খুব খারাপ।ঠিকমত জ্ঞান ফিরছে না!!

 

পায়ে পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাসেতের স্ত্রীকে একটা বেডে রাখা হয়েছে।স্যালাইন চলছে। 

 

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে চাইলাম। সিস্টার বাঁধা দিলেন। 

 

- দেখুন ওর জ্ঞান এখনো ফেরেনি। আপনজন ছাড়া ভেতরে কেউ আসবেন না।

 

আমি দাঁড়িয়ে আছি।

-- উনি আপনার আপনজন কেউ!!

 

হঠাৎ বাবা আমার হাত ধরে টান দিলেন। চলে এসো বৌমা।

 

আমার চলার শক্তি নেই। বাবার হাতের মুঠোয় আমার হাত। 

 

গভীর স্নেহে বুকে টেনে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। 

 

সারাপথ উনি কেঁদেছেন। আমি সব ভুলে গেছি।কী ভাবে কাঁদতে হয়!!

 

দুদিন পর আমার জ্ঞান ফিরলো। 

 

বাসেতের জন্য এতটুকু ভালোবাসা কী আমার হৃদয়ে জন্মায় নি!! 

 

আজ আমি চার  বছরের সাজানো সংসার ফেলে চলে যাচ্ছি।  শেষ বারের মত সংসার নামক - ভালবাসার নীড়টাকে দেখছি।

 

শুধু বুঝলাম  ভালবাসার অপর পিঠে থাকে ঘেন্না। এক প্রতারকের মিথ্যা ভালবাসা বুকে করে আমাকে বাঁচতে হবে!! 

 

 

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

About Author

I am social networker. I like to work this kind site.

Recent Articles
Jul 6, 2024, 8:06 PM affan qureshi
Jul 6, 2024, 12:36 PM affan qureshi
Jul 3, 2024, 1:19 PM affan qureshi
May 1, 2023, 1:50 AM মোহাম্মদ রিদুয়ান